সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক:
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ানো হয়। কিন্তু কমে গেলে সবসময় কমানো হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৮৫ ডলারেরও বেশি বেড়ে গেলে গত মাসে ডিজেল কেরোসিনের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। এই মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে তেলের মূল্য নির্ধারণ হয় সে ব্যবস্থা সংস্কার করা প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম কত টাকা হবে-সেটি একচেটিয়াভাবে নির্ধারণ করে সরকার। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৭ বার ডিজেলের দামে সমন্বয় হয়েছে। যার মধ্যে ১৩ বার বেড়েছে আর কমেছে মাত্র ৪ বার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, ভোক্তা সাধারণ এবং অর্থনীতির গবেষক সবাই সর্বশেষ সরকারের নির্বাহী আদেশে তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে। এই মূল্য বৃদ্ধি অযৌক্তিক বলেও সবাই মতামত দিয়েছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভাড়া বৃদ্ধি আর দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে প্রতিবাদও হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী, আমদানিকারক দেশগুলো নিজস্ব বাজারে তেলের সরবরাহ মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। খুচরা পর্যায়ে তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতায় প্রধানত তিনটি পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। তাই তেলের দাম নির্ধারনে প্রচলিত ৩টি পদ্ধতির মধ্যে অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড অর্থাৎ বাজার দরের সাথে নিয়মিত সমন্বয় পদ্ধতি মেনে চলে। এছাড়া কিছু দেশে আছে প্রাইস সিলিং বা সর্বোচ্চ মূল্য বেধে দেয়ার পদ্ধতি এবং সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি হলো ফিক্সড প্রাইস বা একদর পদ্ধতি।
তেলের দাম নির্ধারণের পদ্ধতিগুলো ব্যাখ্যা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, ‘ফিক্সড প্রাইস হচ্ছে সরকার নির্ধারিত থাকে। আর সিলিং হলো মার্কেট প্রাইসের সাথেই থাকে তবে একটা সর্বোচ্চ মূল্যের ওপরে উঠতে পারে না। সেই সময়টাতে হয়তো সরকার ভর্তুকী দেয়।’ তিনি বলেন, ‘আর মার্কেট প্রাইসের সাথে রিলেটেড যেটা তাদের সমন্বয়ের কোনো লিমিট নাই। যতবার খুশী তারা সমন্বয় করতে পারে। ঘন ঘন করতে পারে, দুই মাস ধরে নাও করতে পারে। এটা আন্তর্জাতিক বাজারের দরের সাথের সরাসরি সম্পর্কিত।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা মনে করে যে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের মূল্য কাঠামোটি প্রতিযোগিতামূলক হওয়া দরকার। অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজারে মূল্যের যে ওঠানামা তার সাথে মিলে একটি নির্দিষ্ট পার্থক্য রেখে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে তার একটা সমন্বয় করা। যেটি কিনা ভারতে হয়ে থাকে। ওরকম একটি কাঠামো আমরাও বিবেচনা করতে পারি।’ তবে মি. মোয়াজ্জেম এটিও মনে করেন যে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলেই কেবল এই পদ্ধতিতে তেলের মূল্য সমন্বয়ে যেতে হবে। বর্তমান করোনা মহামারির মধ্যে যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে করে এই ব্যবস্থায় যাবার সময় এখনি নয়।
এদিকে সম্প্রতি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পরিবহন কৃষি থেকে শুরু করে সব খাতেই এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এবার দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে সরকার ছাড়া আর কেউ যুক্তিযুক্ত মনে করেনি। ছাত্রদের প্রতিবাদ আন্দোলনেও তেলের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম এখন আবার কমছে। গত সপ্তাহে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২ ডলারের মতো কমে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের অপরিশোধিত তেলের দাম কমে এখন ৭০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছে। গতমাসে এই মূল্য ৮৫ ডলারে উঠেছিল।
তেলের দাম, ভাড়া বৃদ্ধিসহ ছাত্রদের বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলনে সম্পৃক্ত একজন ছাত্রী মিতু সরকার ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে যখন তেলের দাম বাড়ানো হয় তখন তারা (সরকার) আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাইটা দেয়। কিন্তু যখন আমরা দেখি যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে তখন তারা সেটি গোচরে আনেন না।’ আরেকজন ছাত্রী উমানা ফাতেমা বলেন, ‘যেহেতু তেলের দামের ওপরে আমাদের পুরো অর্থনীতি নির্ভর করে। তেলের দাম বাড়ার আগে থেকেই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল সমন্বয় করে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা।’
ঢাকায় পিকআপ চালিয়ে জীবনযাপন করা একজন চালকের কথায়, ‘তেলের দাম যে হারে বাড়ে, সেই হারে কমে না। খালি বাড়তেই থাকে।’ এ বাস্তবতায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মতো তেলের দাম নির্ধারণেও রেগুলেটরি কমিশনকে যুক্ত করার জোরালো দাবি দেখা গেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ‘রেগুলেটরের মাধ্যমে হলে হুট করে ওভারনাইট দাম বাড়িয়ে দিল, এটা কিন্তু হতো না। বহু দেশেই সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও দাম নির্ধারণটা কিন্তু রেগুলেটরের মাধ্যমে হয়। সেটা সম্ভব বলে আমি মনে করি।’
রেগুলেটরের মাধ্যমে মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে অধ্যাপক তামিম বলেন, “সরকার যদি দাম বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে রেগুলেটরের হাতেই দাম বৃদ্ধির ক্ষমতা দিতে হবে। সরকারকে প্রস্তাব করতে হবে রেগুলেটরকে। কারণ দেখাতে হবে যে কেন তারা দাম বাড়াতে চান।” “সেখানে কনজিউমারদেরও ভূমিকা থাকবে। তাদের বলার একটা অধিকার থাকবে। এবং সে অনুযায়ী সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রেগুলেটর কতটুকু দাম বৃদ্ধি করবে সেটি নির্ধারণ করবে।”
সবশেষ ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর জ্বালানি বিভাগ বলেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে আবার কমানো হবে। এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে। কতটা কমলে দাম আবার কমানো হবে বা মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে সংস্কার হবে কিনা এসব প্রশ্নে জ্বালানি বিভাগ এই মুহূর্তে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।